বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বর এখন এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও এটি মূলত বর্ষাকালের রোগ হিসেবে বিবেচিত হতো, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে বছরের প্রায় পুরো সময়ই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকছে। এর সবচেয়ে বিপজ্জনক রূপ হলো ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF)। এটি শরীরে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বর্তমান অবস্থা
রোগীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে: ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ও আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে।
শিশু ও তরুণরা ঝুঁকিতে: ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার শিশু ও তরুণদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার চাপ: মৌসুমে একসাথে বিপুল সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংকট তৈরি হচ্ছে।
২০২৩ সালের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব
২০২৩ সালের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং প্রাণঘাতী ছিল। এর বৈশিষ্ট্য ছিল মৌসুম শুরুর আগেই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া, মৃত্যুহার বেশি হওয়া এবং ঢাকার বাইরেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া। রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যু: ২০২৩ সালে মৃত্যুর সংখ্যা আগের ২৩ বছরের মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি ছিল। অক্টোবরের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১,৭০০ জনেরও বেশি। ভৌগোলিক বিস্তার: আগে মূলত ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও, ২০২৩ সালে দেশের সব ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গুর রোগী শনাক্ত হয়। চট্টগ্রাম ও বরিশালে নতুন হটস্পট তৈরি হয়। ভাইরাসের ধরন পরিবর্তন: আগে DENV-3 প্রধান থাকলেও ২০২৩ সালে DENV-2 প্রধান হয়ে ওঠে। একাধিকবার ভিন্ন ধরনে আক্রান্ত হলে গুরুতর ডেঙ্গুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। আগে শুরু ও দীর্ঘমেয়াদি মৌসুম: অন্যান্য বছরের তুলনায় ডেঙ্গু অনেক আগে শুরু হয় এবং বর্ষার পরেও প্রাদুর্ভাব বজায় থাকে। এর পেছনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত দায়ী।
1. আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন: অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় মশা সারা বছর প্রজনন করছে।
2. নগরায়ণের সমস্যা: অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে পানি জমে থাকে, যা এডিস মশার প্রজননস্থল তৈরি করছে।
3. মশার আচরণে পরিবর্তন: সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা এখন ড্রেন ও নোংরা পানিতেও প্রজনন করছে এবং দিনে-রাতে দুই সময়েই কামড় দিচ্ছে।
4. ভেক্টর কন্ট্রোল ব্যর্থতা: প্রচলিত কিটনাশক (যেমন ম্যালাথিয়ন ও টেমেফস) অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে পড়েছে, কারণ মশা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করেছে।5. স্বাস্থ্যসেবার চাপ: বিপুল সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় পর্যাপ্ত বেড ও আইসিইউ সংকট তৈরি হয়।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার কী?
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হলো ডেঙ্গুর একটি জটিল রূপ। এই অবস্থায় শরীরের রক্তনালী দুর্বল হয়ে যায় এবং ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রক্তে প্লাটিলেট কমতে থাকে, ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। অনেক সময় রোগী শকে চলে যেতে পারে যা জীবনহানির কারণ হতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের লক্ষণ , এই উপসর্গ দেখা দিলে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন।-
- তীব্র পেটব্যথা
- বারবার বমি হওয়া
- দাঁত বা নাক থেকে রক্ত পড়া
- বমি বা মলে রক্ত থাকা
- শ্বাসকষ্ট ও বুকব্যথা
- ঠান্ডা, ভেজা ত্বক ও অস্থিরতা
- হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া
কেন ডেঙ্গু এত ভয়ংকর হয়ে উঠছে?
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে কয়েকটি কারণে—
- শহরে ড্রেন ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়া।
- ছাদে বা টবে জমে থাকা পানি এডিস মশার প্রজননের উপযুক্ত জায়গা তৈরি করে।
- জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেড়ে মশার বেঁচে থাকার সময় বাড়ছে।
- মানুষের অসচেতনতা—সময়মতো চিকিৎসা না নেওয়া ও ঘরবাড়ি পরিষ্কার না রাখা।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়


বাংলাদেশে এখনও ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা কার্যকর টিকা নেই। তাই প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও সরকারি পর্যায়ে নেওয়া জরুরি।
১. ঘরোয়া ও পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থা –
- টব, টায়ার, ড্রাম বা ছাদে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া।
- পানির ট্যাংক বা ড্রাম সবসময় ঢেকে রাখা।
- সপ্তাহে অন্তত একদিন বাড়ির সব পানির পাত্র খালি করে শুকিয়ে রাখা।
- নালা ও ড্রেন পরিষ্কার রাখা।
- কমিউনিটি পর্যায়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো।
২. ব্যক্তিগত সুরক্ষা
- সকাল ও বিকালের সময় পূর্ণ হাত-পা ঢাকা পোশাক পরা।
- শিশুদের জন্য মশারোধক লোশন বা মশারি ব্যবহার করা।
- ঘরের জানালা ও দরজায় মশার জাল লাগানো।
- ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করা।
৩. সরকারি উদ্যোগ
- নিয়মিত ফগিং ও মশার লার্ভা ধ্বংসে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
- স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ বাড়ানো।
- হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওয়ার্ড ও আইসিইউ বেড নিশ্চিত করা।
- স্কুল ও কলেজে ডেঙ্গু সচেতনতা ক্লাস চালু করা।
চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে করণীয়
- ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তার দেখানো।
- কখনও নিজে থেকে ইবুপ্রোফেন বা অ্যাসপিরিন খাওয়া যাবে না, এগুলো রক্তক্ষরণ বাড়াতে পারে।
- পর্যাপ্ত পানি পান করা ও বিশ্রামে থাকা।
- জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে।
জনসচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ব
ডেঙ্গু মোকাবিলায় শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সচেতনতা যথেষ্ট নয়। সমাজের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন একসাথে কাজ করলে ডেঙ্গুর প্রভাব অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার প্রতিদিনই একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা, নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও সরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে এ রোগের ভয়াবহতা কমানো সম্ভব। প্রতিটি পরিবার ও সমাজকে সচেতন হতে হবে, কারণ প্রতিরোধই একমাত্র কার্যকর সমাধান।